হাওজা নিউজ এজেন্সি রিপোর্ট অনুযায়ী, যুদ্ধাপরাধের দায়ে অবাধে নারী ও শিশু হত্যাকারী ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু এবং সদ্য পদচ্যুত প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োফ গ্যালান্টের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) গ্রেপ্তারি পরোয়ানা নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।
আল জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গাজায় নিপীড়িত ফিলিস্তিনিদের গণহত্যা এবং গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের পটভূমিতে জারি করা এই পরোয়ানা দৃশ্যত ন্যায়বিচার প্রদানের একটি চিহ্ন হিসাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে; কিন্তু এই উদ্যোগের আসল উদ্দেশ্য অনেক বেশি জটিল এবং গভীর।
ইহুদিবাদী দখলদার রাষ্ট্রের ইতিহাস মানবাধিকার লঙ্ঘন ও গণহত্যার ধারাবাহিকভাবে উঠে এসেছে। ফিলিস্তিনের নির্যাতিত জনগণের গণহত্যা, গাজার ধ্বংস, লেবাননের বিরুদ্ধে আগ্রাসন এবং প্রতিরোধ সংগঠনগুলোকে টার্গেট করার মতো অপরাধগুলো ইসরায়েলের রাষ্ট্রীয় নীতির অংশ।
যাইহোক, এই অপরাধের জন্য শুধুমাত্র নেতানিয়াহুর মতো ব্যক্তিদের উপর দোষারোপ করা এবং নিপীড়ক রাষ্ট্রের সামগ্রিক নৃশংসতাকে উপেক্ষা করা একটি গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ। সিদ্ধান্তটি ইসরায়েলের অপরাধের বিরুদ্ধে একটি পদক্ষেপ বলে মনে হচ্ছে, কিন্তু বাস্তবে এটি ইসরায়েলকে মুক্ত করার এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আইনি সুরক্ষা দেওয়ার চেষ্টা মাত্র।
নেতানিয়াহুকে যুদ্ধাপরাধের জন্য দায়ী করে ইসরায়েলি দখলদার রাষ্ট্রকে অভিশংসন করার কৌশল এমন এক সময়ে এসেছে যখন ইসরায়েলের নৃশংসতা আন্তর্জাতিকভাবে উন্মোচিত হয়েছে। নারী, শিশু ও নিরপরাধ বেসামরিকদের হত্যাযজ্ঞ, ঘরবাড়ি ধ্বংস এবং মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন সত্ত্বেও আন্তর্জাতিক শক্তিগুলো শুধু প্রদর্শনমূলক ব্যবস্থা নিচ্ছে।এতে বোঝা যায়, ইসরায়েলের অপরাধের বোঝা গুটিকয়েক ব্যক্তির ওপর চাপিয়ে বিশ্বের ক্ষোভকে শান্ত করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
এই গ্রেফতারি পরোয়ানার পেছনে আরেকটি বিপজ্জনক দিক হলো বৈশ্বিক ইহুদিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সম্পৃক্ততা। ইসরায়েলের নৃশংসতাকে সবসময় সমর্থনকারী মার্কিন ও ইউরোপীয় শক্তিগুলো এই সিদ্ধান্তকে তাদের নীতির সাফল্য হিসেবে উপস্থাপন করছে, কিন্তু এরাই সেই শক্তি যারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে গাজার ধ্বংস এবং ফিলিস্তিনি জনগণের গণহত্যায় অংশগ্রহণ করে। বাস্তবতা হলো ইসরায়েলের নৃশংসতা কোনো একক ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি একটি সংগঠিত ব্যবস্থা যা বিশ্ব ইহুদিবাদের সমর্থনে পরিচালিত হচ্ছে।
নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও সন্দেহজনক বলে মনে হচ্ছে যখন ইসরায়েল হিজবুল্লাহ, হামাস এবং এই অঞ্চলের অন্যান্য প্রতিরোধ গোষ্ঠীর তীব্র প্রতিরোধের মুখোমুখি হচ্ছে। এই সংগঠনগুলো ইসরায়েলের অপরাজেয়তার ধারণাকে ধ্বংস করেছে এবং তাদের সংগ্রাম ইসরায়েলের অপরাধ বিশ্বের সামনে তুলে ধরেছে।
এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে, ইসরায়েল তাদের রাষ্ট্রীয় নীতি অব্যাহত রাখতে এবং তাদের নৃশংসতা চালিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে তাদের বাঁচানোর জন্য সময় কিনছে। এই পদক্ষেপটি একটি প্রদর্শনী কৌশল যা দ্বারা ইসরায়েলি দখলদার রাষ্ট্র এবং তার বৈশ্বিক পৃষ্ঠপোষকরা তাদের অবস্থানকে সুসংহত করার চেষ্টা করছে।
আজ, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো ইসরায়েলের এই কৌশলগুলিকে স্বীকৃতি দেওয়া এবং নিছক প্রদর্শনী ব্যবস্থার পরিবর্তে ফিলিস্তিনি জনগণের অধিকার পুনরুদ্ধারের জন্য একটি সুনির্দিষ্ট নীতি গ্রহণ করা। ফিলিস্তিনি জনগণের অধিকার পুনরুদ্ধার করা, গাজা ও লেবাননে আগ্রাসনের ফলে সৃষ্ট ধ্বংসযজ্ঞের প্রতিকার এবং এই অঞ্চলে স্থায়ী শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার মূল বিষয়গুলির প্রতি মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন।
নেতানিয়াহু বা তার মতো অন্যদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা সমস্যার সমাধান করবে না। ইসরায়েলের আগ্রাসন বন্ধ করতে, বৈশ্বিক জায়নবাদী ব্যবস্থাকে ভেঙে দিতে হবে এবং এর পৃষ্ঠপোষকদের জবাবদিহি করতে হবে। এই পথই কেবল ফিলিস্তিনি জনগণের অধিকার পুনরুদ্ধার করবে না বরং এই অঞ্চলে স্থায়ী শান্তির নিশ্চয়তা দেবে।
তাই এই সময়ে নির্যাতিতদের অধিকার আদায়ের জন্য ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ অবস্থান গ্রহণ এবং ইসরায়েলের বিরুদ্ধে বাস্তব ও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা সকল মুক্ত জাতি ও মানবজাতির দায়িত্ব। এটাই প্রকৃত ন্যায়বিচার ও স্থায়ী শান্তির নিশ্চয়তা।
এটাও লক্ষণীয় যে ইসরায়েলি আগ্রাসনের পরিধি শুধু ফিলিস্তিনি ভূমিতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, লেবাননে হামলা এবং সেখানে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞও ইহুদিবাদী নৃশংসতার অনস্বীকার্য উদাহরণ। ইহুদিবাদী বাহিনীর দ্বারা আবাসিক এলাকায় হামলা শুধুমাত্র লেবাননের জনগণকে বাস্তুচ্যুত করেনি, বরং তাদের অর্থনীতি, অবকাঠামো এবং সামাজিক স্থিতিশীলতাকেও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
এমতাবস্থায় নেতানিয়াহু এবং অন্যদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানাকে ন্যায়বিচারের পূর্ণ মাপকাঠি হিসেবে ঘোষণা করা বাস্তবের দিকে চোখ ফেরানোর মতো। ব্যক্তিকে দায়ী করে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের সংগঠিত নেটওয়ার্ককে উপেক্ষা করা সুস্পষ্টভাবে ন্যায়ের নীতির পরিপন্থী।
গাজা ও লেবাননে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে নীরব থাকলে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির ভণ্ডামি প্রকাশ পায়। নিপীড়িত জনগণের ক্ষত সারানোর পরিবর্তে তারা শোম্যানশিপের মাধ্যমে তাদের তলানি দেখানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে। এই ধরনের পদক্ষেপ না অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠা করবে, না ইহুদিবাদী আগ্রাসনের ধারাবাহিকতা বন্ধ করবে।
রিপোর্ট: মজিদুল ইসলাম শাহ